কাছের মানুষ না স্বার্থের মানুষ? প্রসেনজিৎ ও দেবের ছবি দর্শকের মনে তুলছে প্রশ্ন

পূজোর মরসুমে সাধারণত দর্শক চায় হাসি-খুশির ছবি, চোখজুড়ানো আনন্দ। কিন্তু অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও সাংসদ-তারকা দেব এবার উৎসবের আবহে নিয়ে এসেছেন এক ভিন্ন স্বাদের ছবি—‘কাছের মানুষ’। যা শুধুমাত্র বিনোদনের খোরাক নয়, বরং একাধিক সমাজসচেতন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় দর্শককে। ছবিটি মূলত ‘কাছের মানুষ’ শব্দের মানে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে—এই ঘনিষ্ঠতা কি নিঃস্বার্থ, না কি এর গভীরে লুকিয়ে থাকে একাধিক স্বার্থের খেলা?

সাধারণ জীবনের অসাধারণ টানাপোড়েন

ছবির কাহিনি আবর্তিত হয়েছে এক সাধারণ পরিবারের চারপাশে। সুদর্শন ঘোষ (প্রসেনজিৎ) এক এলআইসি এজেন্ট, যার ছোট বোন কুসুম (ইশা সাহা) গুরুতর অসুস্থ। তার হার্টের অপারেশনের জন্য প্রয়োজন বিপুল অঙ্কের টাকা। উৎসবের উজ্জ্বলতার বিপরীতে ছবির আবহ একেবারেই ভিন্ন—নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা, বাঁচার জন্য মরিয়া চেষ্টাই ছবির চালিকাশক্তি। উৎসবের আলো যে সব অন্ধকার দূর করতে পারে না, সেই বাস্তবতাকেই সামনে এনেছে এই কাহিনি।

প্রসেনজিতের চরিত্র সুদর্শনের বোনকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হয়ে ওঠে তারই পরিকল্পিত এক বিমা প্রতারণা। কুন্তল (দেব), যে নিজেই চরম বিপদের মধ্যে, হয়ে ওঠে এই ভয়াবহ পরিকল্পনার অংশীদার।

পরিকল্পনার ভয়াবহতা ও এক মানসিক দ্বন্দ্ব

সুদর্শন এক সাক্ষাৎকারে জানতে পারে, কুন্তলের সব সম্পত্তি চিট ফান্ডে নষ্ট হয়েছে, ভাই আত্মহত্যা করেছে, মা অসুস্থ। এই অসহায় অবস্থায় সুদর্শন কুন্তলের নামে একটি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বিমা করায়, যার নমিনি সে নিজেই। পরিকল্পনা এমন যে কুন্তলকে এমনভাবে মরতে হবে, যাতে তা দুর্ঘটনা বলে মনে হয়। বিমার টাকায় সুদর্শনের বোনের চিকিৎসা হবে, এবং বাকিটা কুন্তলের মায়ের দেখাশোনায় ব্যয় হবে।

এই অদ্ভুত ও মানবিক জটিলতার মুখে দাঁড়িয়ে কুন্তল রাজি হয়, কারণ তার সামনে আর কোনও রাস্তা খোলা থাকে না। এ যেন নিঃস্বার্থ সম্পর্কের আবরণে জড়িয়ে থাকা এক ভয়াবহ স্বার্থের চিত্র।

দুই মহাতারকার অসাধারণ কেমিস্ট্রি

বাংলা চলচ্চিত্রে অনেকদিন ধরে এমন একটা বিশ্বাস ছিল যে দুই শীর্ষ তারকা এক ছবিতে দেখা দিলে একে অপরকে জায়গা দিতে পারেন না। কিন্তু এই ছবিটি সে ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। প্রসেনজিতের অভিজ্ঞতা এবং দেবের তারুণ্য একসঙ্গে ছবিকে এনে দিয়েছে গভীরতা ও বাস্তবতা। তারা কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নন, বরং একে অপরের পরিপূরক। এই ছবিতে তাঁদের যৌথ অভিনয় বাংলা চলচ্চিত্রকে আরও এক ধাপ উন্নত করেছে বলেই মনে করছেন অনেকে।

শুধু পূজোর ছবি নয়, এক সমাজচিত্রও বটে

এই ছবি শুধু উৎসবের সময় উপযোগী বিনোদন নয়, বরং সমাজের গভীর বাস্তবতাকে তুলে ধরার চেষ্টা। এখানে আছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, আবার একইসঙ্গে আছে আর্থিক চাপে জন্ম নেওয়া হিংসা ও অবিশ্বাস। শক্তির আরাধনার সময় এইসব অন্ধকার দিক ভুলে যাওয়ার বদলে, তা বুঝে এবং মোকাবিলা করাই তো প্রকৃত উৎসবের অর্থ—এই বার্তাই যেন দিতে চেয়েছেন নির্মাতারা।

‘কাছের মানুষ’ ছবি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সবসময় যে কাছের মানুষই আপনার আপন হবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। অনেকসময় সম্পর্কের গভীরে লুকিয়ে থাকে এমন কিছু সিদ্ধান্ত, যা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এই ছবির মাধ্যমে দেব ও প্রসেনজিৎ যে মানসিক সংঘাত ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, তা বাংলা ছবির ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।